ফুটবল জাদুকর সৈয়দ আব্দুস সামাদ - বাংলা ফুটবলের কিংবদন্তী নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা
ফুটবলের জাদুকর আবদুস সামাদ যার পুরো নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। জন্ম:ডিসেম্বর ৬, ১৮৯৫ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমানে অবিভক্ত বাংলায় জন্ম হলেও দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানকেই তিনি মাতৃভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি (পূর্ব পাকিস্তানের) বাংলাদেশের পার্বতীপুরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ী হন। জীবদ্দশায় স্বাধীণ সার্বভৌম বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি তিনি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ০২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ পূর্ব বাংলার সৈয়দপুরে। ভারত উপমহাদেশের ফুটবল যাদুকর হিসেবে খ্যাত। উপমহাদেশের ফুটবলামোদীদের কাছে জাদুকর সামাদ নামে পরিচিত। সামাদ ড্রিবলিং এবং গোলে লক্ষ্যভেদী শটের জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং মাঠে লেফট-আউট পজিশনে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
.jpeg)
ফুটবল জাদুকর নামটি কেমন করে হলো
বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের কথা। তখন ইংরেজ শাসনামল। একদিন বিকেলে কলকাতার ইডেন গার্ডেনের বিপরীত দিকের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন প্রায় ছয় ফুট লম্বা একজন লোক। হঠাৎ তাঁর পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন স্বয়ং তৎকালীন বাংলার গভর্নর এবং তাঁর কন্যা। গভর্নর সোজা এগিয়ে গিয়ে আঁকড়ে ধরলেন ঐ লোকটাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় গভর্নরের সঙ্গী-সাথীদের সবাই হতভম্ভ। লম্বা লোকটির হাত ধরে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর, নিজের মেয়েকে ডেকে বললেন, 'এসো, ফুটবলের জাদুকরের সঙ্গে পরিচিত হও (Meet the wizard of football)।' এভাবেই সৈয়দ আব্দুস সামাদের নামের আগে ‘জাদুকর’ উপাধি টি দিয়ে দিলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর। তিনি তাকে ডাকতেন wizard of football বলে।
খেলোয়াড় জীবন কিছু কথা
ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলায় দক্ষতার প্রদর্শন করেন পায়ের জাদুতেই ছিল তাঁর জাদু। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই তাঁর পড়াশোনা সমাপ্ত। কিশোর বয়সে তিনি ফুটবল খেলতেন পূর্ণিয়া ডিস্ট্রিক্ট টাউনের হয়ে। কিষাণগঞ্জ স্কুলের বিপক্ষে পূর্ণিয়াতে হওয়া একটি ফোকাস কাপের ম্যাচে তিনি ১০টি গোল করেন। ১৯১২ সালে কলকাতা মেইন টাউন ক্লাবে এবং ১৯৩৩ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দিয়ে সামাদ ফুটবল জগতে আলোড়ন তোলেন।
তার নেতৃত্বে মোহামেডান পরপর পাঁচবার আইএফএ শিল্ড ও লিগ জয় করে। ১৯২৪ সালে তিনি ভারতের জাতীয় ফুটবল দলে নির্বাচিত হন এবং ১৯২৬ সালে দলের অধিনায়ক হন। তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল গ্রেট ব্রিটেন, বার্মা, সিলোন, মালয়, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো শক্তিশালী দলগুলোর বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় জয় পায়। চীনের বিপক্ষে তাঁর ফুটবল ক্রীড়াশৈলী লক্ষ করে জনৈক স্কটিশ ক্রীড়াবিদ বলেছিলেন যে- সামাদ ইউরোপে জন্মালে খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বসেরার খেতাব পেতেন। আবদুস সামাদের ক্রীড়া-জীবন ছিল মাত্র ২৩ বছরের, ১৯১৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যেই তিনি আপামর ফুটবলপ্রেমীর চোখে অসামান্য দক্ষতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন যা বাঙালির কাছে অত্যন্ত গর্বের। বিভিন্ন সূত্র মতে তিনি ১৯৪১ সাল অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবল খেলেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক্ত ফুটবল কোচ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৪৪ সালে তিনি তাঁর ছেলে গোলাম হোসেনের সঙ্গে একসাথে ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ে দলে খেলেন।
ফুটবল জাদুকরের জাদুকরি ঘটনা
সালটা খুব সম্ভবত ১৯৩৩-১৯৩৪, সর্বভারতীয় ফুটবল দল ইন্দোনেশিয়া সফরে। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচে খেলছে দুই দলেরই তুখোড় সব খেলোয়াড়। চেষ্টা চালালেও কোনো পক্ষই গোল করতে পারছে না। আমাদের জাদুকর সামাদ ৪-৫ জন কে কাটিয়ে তীব্র শুট করলেন গোলবারে কিন্তু গোল হলো বলটি লাগলো গোলবারে। এর ঠিক মিনিট পাঁচের পর আবার একই শট এবং একইভাবে গোলবারে লেখে বল ফিরে আসে বল । জাদুকর সামাদ ভাবছেন তাঁর শর্ট ম্যাজারম্যান্ট তো এমন হবার কথা না। কিছু একটা সমস্যা এই গোলবারের নিশ্চয় আছে। গোলপোস্টের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রেফারিকে বলেন নিশ্চয় গোলপোস্টের উচ্চতা কম আছে। রেফারিসহ বাকিরা অবাক হলেও অবাক হলেন না ভারতীয় দলের অন্যান্য সদস্যরা। সবার দাবিতে রেফারি খেলা থামিয়ে ফিতা আনতে বাধ্য হলেন। পরে মেপে দেখলেন, আসলেই গোলপোস্টের উচ্চতা দেড় ইঞ্চি কম। বাতিল করা গোলটা তখন গোল বলে গণ্য হলো। তার সম্পর্কে আরো অনেক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তিনি নাকি খেলতে নেমে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিতেন, আর বাদাম খেতেন। ও হ্যাঁ, গোঁফে তা দেওয়াটাও ছিল সামাদের একটা স্বভাব। দলের অবস্থা যখন খারাপ হয়ে যেত, অথবা খেলার সময় যখন প্রায় শেষ সময়, তখন সঙ্গী খেলোয়াড় আর দর্শকদের চিৎকারে মাঠে নেমে ২/৩ টা গোল করে আবার ফিরে যেতেন আগের কাজে। গোল করা যেন তার কাছে ছিল ইচ্ছের বিষয়। জীবনে বহু ম্যাচের আগে নাকি খেলা শুরুর আগেই বলে দিয়েছেন কয়টা গোল করবেন, এবং দিনশেষে সেটাই করে ফেলেছেন।
![]() |
কলকাতা মহামেডান খেলোয়ারকালীন সময় |
ফুটবল জাদুকরের শেষ জীবন
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সামাদ দিনাজপুরের পার্বতীপুর বলে এক শহরে চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে। পার্বতীপুর সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত বৃহৎ রেলওয়ে শহর। যদিও রেলওয়ের কোনো প্লাটফর্মে ইন্সপেক্টর পদ ছিল না, তবুও সামাদের সম্মানার্থে এই পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ১০ বছর এখানেই চাকরি করে গিয়েছেন সামাদ। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বাস করতেন রেলওয়ে কলোনিতে সামাদের জন্য বরাদ্দকৃত একটা ছোট বাংলো বাড়িতে। ঢাকায় একটা প্রদর্শনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে যেখানে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। সরাসরি খেলায় অংশ না নিলেও সেই প্রদর্শনী ম্যাচে জার্সি পড়ে সারা মাঠে হেঁটে ‘ফুটবলের জাদুকর’ সামাদ দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন বলে জানা যায়। প্রচণ্ড দারিদ্র্যেই কেটেছে তাঁর শেষ জীবন। ১৯৫৭ সালে তাঁকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। আর ১৯৬২-তে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সম্মানজ্ঞাপন করে।
এই মহান জাদুকরের শেষ সময়টা কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। মৃত্যুর আগে একবার তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি তো নিঃশেষ হয়ে গেছি। আমার প্রাপ্য মর্যাদা আমি পেলাম না। আমি ধুঁকে ধুঁকে মরে যাব সেটাই ভালো। কারো করুণা এবং অনুগ্রহের প্রত্যাশী আমি নই”। অবশেষে দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিনা চিকিৎসায় ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এই ফুটবলের জাদুকর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পার্বতীপুরেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন বিশ্ব ফুটবলের এই মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর সমাধিগাত্রে শ্বেতপাথরে লেখা আছে, ‘‘চিরনিদ্রায় শায়িত ফুটবল জাদুকর সামাদ’’।
![]() |
ফুটবল জাদুকরের সমাধি |
পার্বতীপুর শহরের ইসলামপুর কবরস্থানে সমাহিত করার দীর্ঘ ২৫ বছর অবহেলিত ও অরক্ষিত থাকার পর ১৯৮৯ সালে ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ।
![]() |
ফুটবল জাদুকর স্মৃতি স্মরক খাম |
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের ডাকবিভাগ সৈয়দ আবদুস সামাদের স্মৃতিতে একটি স্মারক ডাকটিকিট এবং একটি উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে। তাঁর স্মরণে একটি স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার । পার্বতীপুরে রেলওয়ে নির্মিত "সামাদ মিলনায়তন" নামের একটি মিলনায়তন আছে।
![]() |
ফুটবল জাদুকর স্মৃতি স্মরক ডাকটিকিটি |
এই হলো ফুটবল জাদুকরের প্রাপ্য সম্মান একটা স্মৃতিসৌধ, একটা স্মারক ডাকটিকিট এবং একটা মিলনায়তন। নতুন প্রজন্মের জানা প্রয়োজন আমাদেরও একজন ফুটবল জাদুকর ছিলেন। তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি আর ভালবাসা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন