হাফিজুর রহমান বাবুল থেকে লালন সাধক বাউল পাগলা বাবুল সাঁই
বাউল পাগলা বাবুল নামের এই বাউল সাধক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মায়ের কথায় নাম লেখান মুক্তিবাহিনীতে এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন ৮ নম্বর সেক্টরে। তাঁর দাদি আদর করে ডাকতেন পাগলা। সেই ডাক ধরে হাফিজুর রহমান বাবুল থেকে পাগলা বাবুল। মা'য়ের প্রেরনায় লালন গান শিখতে চলে আসেন কুষ্টিয়া। সান্নিধ্য লাভ করেন ফকির সাধক সাধু গুরু খোদা বক্স শাহের। ১৯৮৯ সালে প্রথম বাংলাদেশ বেতারে গাওয়া। ১৯৯৮ সালে তিনি অর্জন করেন শিল্পকলা একাডেমীর মেন্টর ফেলোশিপ ইন মিউজিক। ১৯৯৭ সালে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ‘পঞ্চম', ২০০১ এ 'কি যাদু বাংলা গানে' আর সর্বশেষ এ্যালবাম 'পাগলা বাবলুর লালনমেলা’।
![]() |
বাউল পাগল বাবুল |
কবি শামসুর রহমান তাঁর "সৌন্দর্য আমার ঘরে" (১৯৯৮ সালে প্রকাশিত) কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা প্রকাশিত করেছিলেন বাউল সাধক পাগলা বাবুলকে নিয়ে । কবিতাটার নাম "পাগলা বাবুলের গান"--
গেরুয়া বসনধারী পাগলা বাবুল
যখন বাউল গান গায় গভীর তন্ময়তায়
একতারা বাজিয়ে, আঙুলে
ফুটিয়ে সুরের বনফুল
নেচে-নেচে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে
পাগড়ি-বাঁধা মাথা
ছেঁউড়িয়া, ফরিদপুরের গঞ্জ-গ্রামে,
শহর ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি
আর রমনার বটমূলে
আবার লালন সাঁই আসরে নামের পুরোদমে।
পাগলা বাবুল গলা ছেড়ে গান গাইলেই আমার অন্তরে
দীঘির বৈকালী ঘাটে গ্রাম্য বধূটির
কলস ভাসানো,
নতুন শস্যের ঘ্রাণ, ক্ষেতের আইল,
পথের রঙিন ধুলো, নিঃসঙ্গ লোকের পথ হাঁটা,
ডুরে শাড়ি-পরা কিশোরীর কাঁচা আম খাওয়া,
ভাসমান নৌকা আর ঘুঘুর উদাস
ডাক জেগে ওঠে। মনে হয়,
নিঝুম মহীন শাহ ভরা নদীর ধরনে মাথা নাড়ছেন।
এবং পাগলা বাবুলের একতারা
যখন সুনীল আকাশকে ছুঁতে চায়,
ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মাথা আর নেচে-নেচে
যখন সে অগণন মানুষের মাঝে মানুষের গান গায়
আমি শুদ্ধ আলোর ভিতরে যাত্রা করি।
শুদ্ধ লালন চর্চার বিকাশ তাঁর একমাত্র স্বপ্ন। জানি না এখন আছে কি না এক সময় প্রতি বৃহ:বার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লালন সাঁইজির গান ভেসে আসতো কানে। বাউল পাগলা বাবুলের প্রতিষ্ঠিত লালন চর্চা কেন্দ্রের উদ্যোগে। অনেককেই হাতে কলমে লালন সাঁইজির গানে দিক্ষা নিতে দেখেছি।
কিংবদন্তী সাধক বাউল পাগলা বাবুলের কন্ঠে অমৃত লালন বানী:-
১. তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে---
তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে
একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে
একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে
পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকির লালন হয় তরাসে
অদ্বৈ নিতৈই চৈতে পাগল নাম ধরেছে।
২. ধাক্কায় যেনো যাসনে চটে ফেটে- কে যাবি গৌর প্রেমের ঘাটে--
কে যাবি গৌর প্রেমের ঘাটে,
ধাক্কায় যেন যাসনে চটে ফেটে
প্রেম যমুনার তরঙ্গ বাড়ি
ধাক্কা লাগে ব্রহ্মপুরী
চতুরলী থাকলে বল
প্রেম যাজনে বাধবে কলহ
হারিয়ে শেষে দুটো কুলোও
কাঁদাকাঁটি পথে ঘাটে
কর্মযোগে ধর্ম তারই,
কারো বেঁচে ওঠে
আগে দুঃখ পরে সুখ
সয়ে বয়ে যদি কেউ রয়
ফকির লালন বলে প্রেম পরশ পায়
সামান্য জ্ঞানে কি তাই ঘাটে।
৩. আমার ঘর খানায় বিরাজ করে---
ও আমি জনম ভরে একদিনও না
আমি দেখলাম তারে
আমার ঘর খানায় কে বিরাজ করে
নড়েচড়ে ঈশানকোণে
দেখতে পাইনে এই নয়নে
হাতের কাছে যার ভবের হাট বাজার
ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে
সবে বলে প্রাণপাখি
শুনে চুপে চেপে রাখি
জল কি হুতাশন মাটি কি পবন
কেউ বলে না একটা নির্ণয় করে
আপন ঘরের খবর হয়না
বাঞ্চা করি পরকে চেনা
লালনও বলে পর বলতে পরমেশ্বর
সে কি রূপ আমি কি রূপ রে
৪. দেখ না মন ঝাকমারি এই দুনিয়াদারি --
পরিয়ে কৌপনি ধ্বজা
কি মজা উড়ালো ফকিরী
দেখ না মন ঝাকমারি
এই দুনিয়াদারি
যা করো তাই করো রে মন
পিছের কথা রেখ স্মরণ বরাবরই
তোমার সাথে সাথে ফিরছে শমন
কখন হাতে দেবে দড়ি
দরদের ভাই বন্ধুজনা
মরলে সঙ্গে কেউ যাবেনা মন তোমারই
তোমায় খালি হাতে একা পথে রে
বিদায় করে দেবে তরী
বড় আশার বাসা এ ঘর
পড়ে রবে কোথায় আবার
ঠিক নাই তারই
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় লালন ভেঁড়োরে
হোস নে কারো ইন্তেজারি।
৫. কারে দিব দোষ নাহি পরের দোষ - আপন মনের দোষে আমি পলাম রে ফেরে--
কারে দিব দোষ নাহি পরের দোষ
আপন মনের দোষে আমি পলাম রে ফেরে
আমার মন যদি বুঝিত, লোভের দেশ ছাড়িত
লয়ে যেত আমায় বিরজা পারে
মনের গুণে কেউ হলো মহাজন
ব্যাপার করে পেল অমূল্য রতন
আমারে মজালি ওরে অবোধ মন
পারের সম্বল কিছু রাখলাম না রে
অন্তিম কালের কালে কিনা জানি হয়
একদিন ভাবলি না অবোধ মনরায়
মনে ভেবেছ এ দিন এমনি বুঝি যায়
জানা যাবে যেদিন শমনে ধরে
কামে চিত্ত হত মন রে আমার
সুধা ত্যেজে গরল খাই বেসুমার
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় লালন তোমার
ভগ্নদশা ঘটল আখেরে
৬. সদাই বলরে মন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আইন ভেজিলেন রাসুলুল্লাহ
সদাই বলরে মন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
আইন ভেজিলেন রাসুলুল্লাহ
সদাই বলরে মন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
লা ইলাহা নফি যে হয়
ইল্লালাহ সেই দ্বীন দয়াময়
নফি এজবাত ইহারে কয়
এহি তো এবাদতুল্লাহ
নামের সহিত রূপ
ধিয়ানে রাখিয়া জপো
বেনিশানায় যদি ডাকো
চিনবি কি রূপ কে আল্লাহ
লা শরিক জানিয়া তাকে
জপ কালাম দেলে মুখে
মুক্তি পাবি থাকবি সুখে
দেখবি রে নূর তাজেল্লা
বলেছেন সাঁই আল্লাহ নূরি
এই জেকেরের দরজা ভারি
সিরাজ সাঁই তাই কয় ফুকারি
শোন রে লালন বেলিল্লাহ
কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা
হাওয়া দমে দেখ তারে আসল বেনা
বিনা তেলে জ্বলে বাতি
দেখতে যেমন মুক্তা মতি
জলময় তার চতুর্ভিতি মধ্যে খানা
তিল পরিমাণ জায়গা সে যে
হদ্দরূপ তাহার মাঝে
কালায় শোনে আঁধলায় দেখে নেংড়ার নাচনা
যে গঠিল এ রঙমহল
না জানি তার রূপটি কেমন।
সিরাজ সাঁই কয় নাইরে লালন তার তুলনা
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমন ঘর
শূন্যের উপর পোস্তা করে
সবে মাত্র একটি খুঁটি
খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি
কিসে ঘর রবে খাঁটি
ঝড়ি তুফান এলে পরে
মূলাধার কুঠুরি নয়টা
তার উপরে চিলেকোঠা
তাহে এক পাগলা বেটা
বসে একা একেশ্বরে
উপর নিচে সারি সারি
সাড়ে নয় দরজা তারি
লালন কয় যেতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে
৯. যার যার ধর্ম সেই সে করে তোমার বলা অকারণ- সব কি হবে ভরে ধর্মপরায়ণ
যার যা ধর্ম সেই সে করে
তোমার বলা অকারণ।।
কাঁটার মুখ কেউ চাঁছে না
ময়ূর চিত্র কেউ করে না।
এমনি মতে সব ঘটনা
যার যাতে আছে সৃজন।।
চিন্তামণি পদ্মিনী নারী
এরাই পতিসেবার অধিকারী।
হস্তিনী শঙ্খিনী নারী
তারা কর্কশ ভাষায় কয় বচন।।
শশক পুরুষ সত্যবাদী
মৃগপুরুষ উর্ধ্ধভেদী।
অশ্ব বৃষ বেহুশ নিরবধি
তাদের কুকর্মেতে সদাই মন।।
ধর্ম কর্ম আপনার মন
করে ধর্ম সব মোমিনগণ।
লালন বলে ধর্মের করণ
প্রাপ্তি হবে নিরঞ্জন।।
--- বাউল পানকৌড়ি - ০৪.০১.২০২৫
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন