কালজয়ী গীতিকার আবু জাফর- আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি

আবু জাফর
গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, শিক্ষক ও কবি। পেশাগতজীবনে তিনি ছিলেন শিক্ষক। চুয়াডাঙ্গা কলেজ ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। রাজশাহী ও ঢাকা বেতার এবং টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার। জন্ম ১৫ মে ১৯৪৩ কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চাঁদপুর ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামে। সাহিত্যচর্চাও করতেন কবিতার বইও প্রকাশিত করে গেছেন। ‘রাত্রি পুরনো দিন’ (কাব্য), ‘বাজারে দুর্নাম তবু তুমিই সর্বস্ব’ (কাব্য), ‘বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা’ (অনুবাদ কাব্য)। কিংবদন্তি গীতিকার ও শিল্প সাধক এই শিল্পী ২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর ঠিক ৩টা ৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহান এই শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। 



তাঁর লেখা এবং সুর করা ’এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে’ বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর রচিত বেশিরভাগ গানের সুর ও কণ্ঠ তিনি নিজেই দিয়েছেন। তবে আলোচিত বেশিরভাগ গানেই কণ্ঠ দিয়েছেন আবু জাফরের প্রাক্তন স্ত্রী দেশবরেণ্য কন্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। আরো অসংখ্য কালজয়ী গানের মধ্যে:-

=> আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি
=> এই পদ্মা এই মেঘনা যমুনা সুরমা নদী তটে
=> নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে। 
=> তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম
=> তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি। 
=> ও পাখিরে আয় দেখে যা কেমন আছি। 
=> গল্পের শেষ আছে যেতে যেতে একদিন। 
=> বিধিরে তুই আমায় ছাড়া রঙ্গ করার মানুষ দেখলি না।
=> ও নদীরে তোর কোন কি ব্যাথার দোসর নাই। 
=> কি হবে জেনে আমি কেমন আছি। 
=> আমি সাগরেরও নীল নয়নে মেখেছি।
=> এই দেশ আমার লক্ষ মানিক গজমতির হার।
=> মহা মিলনের সাগর তীরে আমার এ দেশ দাড়িয়ে।
=> কত বন্ধুর পথ যেনো পেড়িয়ে এলাম। 
=> এ দেশের নাম রেখেছি সোনার বাংলাদেশ।
=> আকাশের পালক ছুঁয়ে সারাদিন কত ভাষায় গল্প শোনায় পাখি। 
=> পদ্মা আমার মায়ের মত বুকের মরমে দিলো ঠাই।
=> বহু দেশ বহু পথ ঘুরে ঘুরে এসেছি।
=> এত দিন পরে আমি তোমারি হলাম।
=> কিশোরী বউ যায় চোখের জলে ভেসে ভেসে কিশোরী বউ যায়।
=> মনে আছে সেই আমি একবারে কাঁদিয়া ছিলাম।
=> এই কি রঙ্গ জীবনে এই কি রঙ্গ আমার একি রঙ্গ।
=> এ জীবনে আর কোন স্বাদ নেই ।
=> বহু দিন হলো ভেঙ্গেছি ঘর।

(১) 
আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখি
কথা সুর ও কন্ঠ- আবু জাফর
 
আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি 
ক্লিওপেট্রা কি মোমতাজ কেউ নয় 
আমি তোমাকে দেখেছি 
তোমাকে দেখেই জেনেছি 
কেন গড়েছিল তাজমহল কেন পুড়েছিল ট্রয়!! 
হাফিজ বিকালো বুখারা সমরখন্দ 
প্রিয়ার কপোলে একটি তিলের জন্য, 
পাহাড় কেটেছে বুকের পাজর ভেঙে 
কিছু না পেয়েও তবু 
ফরহাদ জীবন মেনেছে ধন্য; 
কোথায় হাফিজ, কোথায় যে শিরী, কোথায় বৃন্দাবন 
আমি তোমাকেই দেখে জেনেছি 
শত গোপিনীর বাহুলতায় অবহেলে 
শ্যামের বাশরী কেঁদে কেঁদে কেন 
রাধিকার কথা কয় 
কেন গড়েছিল তাজমহল কেন পুড়েছিল ট্রয়!! 
রামগিরী থেকে বিরহীযজ্ঞ শুনি 
চিঠি লিখেছিল শ্রাবনের মেঘে মেঘে, 
কত পথ ভেঙে জীবনানন্দ শেষে পথের ঠিকানা 
পেয়েছিল খুঁজে কার চোখে চোখ রেখে; 
কোথায় কে ছিল কালিদাস কবে, নাটোরের বনলতা 
আমি তোমাকেই দেখে জেনেছি 
শত গোপিনীর বাহুলতায় অবহেলে 
শ্যামের বাশরী কেঁদে কেঁদে কেন 
রাধিকার কথা কয় 
কেন গড়েছিল তাজমহল কেন পুড়েছিল ট্রয়!! 
আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি 
ক্লিওপেট্রা কি মোমতাজ কেউ নয় 
আমি তোমাকে দেখেছি 
তোমাকে দেখেই জেনেছি 
কেন গড়েছিল তাজমহল কেন পুড়েছিল ট্রয়!!


(২) 
এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ- আবু জাফর ও ফরিদা পারভীন (দ্বৈত) 
কন্ঠ- ফরিদা পারভীন

আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এই আমার দেশ এই আমার প্রেম
আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে
এই পদ্মা এই মেঘনা
এই যমুনা-সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এ আমার দেশ এ আমার প্রেম
আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে
কত আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে।
এই মধুমতি-ধানসিঁড়ি নদীর তীরে
নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে
এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদ পটে
আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে
কত আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে।
এই পদ্মা এই মেঘনা
এই হাজার নদীর অববাহিকায়
এখানে রমণীগুলো নদীর মতন
নদীও নারীর মতো কথা কয়।
এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে
নির্ভয় নীলাকাশ রয়েছে নুয়ে
যেন হৃদয়ের ভালোবাসা হৃদয়ে ফুটে
আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে।
এই পদ্মা এই মেঘনা
এই যমুনা-সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এ আমার দেশ এ আমার প্রেম
আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে
কত আনন্দ বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে।।


(৩) 
নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গাঁয়ে
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ- ফরিদা পারভীন

নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গাঁয়ে
প্রেমের কী স্বাদ আছে বলো
আঁধার না থাকে যদি কী হবে আলোর
প্রেমের কি স্বাদ আছে বলো।
বাঁশি ডেকে বলে যমুনাকে
অপবাদ যতই আসুক
রাই কি কখনও ঘরে থাকে
কলঙ্ক না লাগে যদি
ভালোবেসে লাগে কী ভালো।
হৃদয়ের যমুনাকে জানি
লাজ-ভয় সুনীল জলে
ধুয়ে যাবে যত কানাকানি
ফুলের মুখে কান দিয়ে
বিনোদিনী কূল খুঁজে নিল।।


(৪) 
তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ- ফরিদা পারভীন

তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম
সে এখন ঘুমটা পরা কাজল বধু
দুরের কোন গাঁয়
পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়।
বৃষ্টি ঝরা পথের ধারে আম কুড়াতে এসে
ভেজা হাতে ডাকলও আমায় বললো ভালোবেসে
এখানে আম কুড়ানোর ধুম লেগেছে
চলনা অন্য কোথাও যাই
যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে আনা যায়
দুপুর বেলা মল্লিকাদের আটচালাতে গিয়ে
পুতুল খেলার ছল করেছি হৃদয় দিয়ে নিয়ে
সে কথা ভাবলে এখন বর্ষা নামে
দুচোখে সজল ভরসায়
যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে আনা যায়
তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম।।


(৫) 
তুমি রাত আমি রাত জাগা
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ-  আবু জাফর ও ফরিদা পারভীন 

তুমি রাত
আমি রাত জাগা পাখি
তুমি নদী 
আমি শ্যামল দু’কূল হয়ে তোমাকেই বাঁধিয়া রাখি
ওগো তোমাকেই বাঁধিয়া রাখি
তুমি রাত 
আমি রাত জাগা পাখি।।
শুনি কেউ বলে তুমি না কি চঞ্চলো অলি
না হলে তোমায় কেনো মহুয়া বলি
আমি ফুল তুমি অলি
সুরের ডানায় ভেসে তাই কি এমন করে
এতো কাছে আসলে না কি।।
ছিলো একাকী আঁধার পথে হারানোর ভয়
তুমি ছাড়া কে আমার আছে পরিচয়
আমি শুক তুমি সারি
সব স্মৃতি মুছে দিয়ে তাই কি এমন করে
এতো ভালবাসলে না কি।।


(৬) 
ও পাখি দেখে যা কেমন আছি
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ-  আবু জাফর ও ফরিদা পারভীন

ও পাখী রে 
আয় দেখে যা কেমন আছি
একবার আয় দেখে যা কেমন আছি 
এখানে শাল পিয়াল আর আমলকী বন
এখানে দীঘির জলে শাপলা ফোটে ,
এখানে মনের সুখে বাই তরণী উজান ভাটি ।
ও পাখি আয় না ফিরে
বাউলের একতারাতে ভিড় জমেছে
দেখে যা শিউলিঝরা উঠোন ঘিরে
দেখে যা, ধানের ক্ষেতে 
দোল খেয়ে যায় রোদের হাসি।।
ও পাখি আয় না ফিরে
আধারের দিন ফুরালো এবার জানিস
ভালবাসে গড়বো আবার এই মাটিরে
এখানে ছড়ায় রেনু হৃদয় ভার আলোর মাঝে।।


(৭) 
গল্পের শেষ আছে 
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ-   ফরিদা পারভীন

গল্পের শেষ আছে যেতে যেতে একদিন
নদীও সাগরে গিয়ে মেসে
শুধু হৃদয়ের অনুরাগ শেষ হবে না
জন্মভূমি কে ভালোবেসে।
এখানে আকাশ যেনো মায়ের দু’চোখ
সারাদিন মেলে রাখে সোনার আলো
জোনাকিরা ছুঁয়ে যায় ঘুমের শিয়রে যেনো
সারারাত কাছে এসে।
সবুজ ঘাসের বুকে মৌসুমিতে
ছড়ায় সুরের প্রেম অন্তবিহীন
দিনভর নিল আকাশ সুরোভিত নিশ্চিত
কবিতার ডানায় ভেসে।

(৮) 
বিধিরে তুই আমায় ছাড়া রঙ্গ করার মানুষ দেখলি না
কথা ও সুর- আবু জাফর
কন্ঠ- ফরিদা পারভীন

বিধিরে তুই আমায় ছাড়া রঙ্গ করার মানুষ দেখলি না
আমার বুকটা ভরে তৃষ্ণা দিলি
সেই পিয়াসা মিটায়
এমন মানুষ দিলি না।
আমার গেহ ভরা সুখ দিয়েছিস স্নেহ ভরা মন
স্বভাবটাকে মিছে মিছে করলি উচাটন
এই বেহায়া মনকে বাঁধে
এমন একটা মধুমতি মনকে দিলিনা।
আমি বিঁষের জ্বালায় জ্বলে পুড়ি কিসের অপরাধ
পুরলো না মোর এই জীবনের একটুখানি সাধ
দু\’চোখ ভরা জল দিয়েছিস
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে কোনো সঙ্গি দিলিনা।।

--------------------------------------------------------------------------------




---- বাউল পানকৌড়ি





মন্তব্যসমূহ