ধ্রুব এষ এর লেখা গান যত - আমি পাতার দলে আছি

বাংলাদেশের কিংবদন্তি প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ। ৫০ হাজারের বেশি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন তিনি এবং করেই যাচ্ছেন এ কাজে তাঁর কোন ক্লান্তি নাই। জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলায়। প্রথম প্রচ্ছদ ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু কলা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র সেই সময়। কবি মোস্তাক আহমেদ এর কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ অঙ্কন করে। তারপর পুরোটাই ধ্রুবময় কিংবদন্তির কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ করে উঠে আসেন খ্যাতির শিখর থেকে শিখরে। তিনি একজন চিত্রশিল্পী এবং সাহিত্য চর্চার প্রেক্ষাপটে একজন সব্যসাচী বলা যায়। কবিতা গল্প উপন্যাস আর শিশু সাহিত্যে তার মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। শিশুদের ভালোবাসেন শিশুদের জন্য লিখতেও ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসায় অবদান রেখে ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছেন। তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর প্রার্থনা সব সময়। তাকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়ে যতটুকু জেনেছি উনি একজন ঋষি, উনি একজন হিমু , উনি একজন বাউল, উনি একজন শিশু। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা নিরন্তর। গান লিখছেন ২০০৭ সালে প্রথম প্রকাশিত নিয়ন আলোয় স্বাগতম নামের মিক্সড অ্যালবামে 'একটু বসিয়া থাকো' শিরোনামে। তারপর থেকে খুব বেশি না হলেও গান রচনা করেছেন। সেই সব গানের কথা বা লিরিক্স সবার জন্য।

-------------------------------------------
(১)
একটু বসিয়া থাকো
কথা- ধ্রুব এষ
কণ্ঠ- কনক আদিত্য ও কার্তিক
অ্যালবাম- নিয়ন আলোয় স্বাগতম।

তুমি আমার পাশে বন্ধু হে
বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো।।
আমি মেঘের দলে আছি
ঘাসের দলে আছি।।
তুমিও থাকো বন্ধু হে
বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো…

রোদের মধ্যে রোদ হয়ে যাই
জলের মধ্যে জল।।
বুকের মধ্যে বন্ধু একটা
নিঃশূন্য অঞ্চল।।

আমি পাতার দলে আছি
আমি ডানার দলে আছি।।
তুমিও থাকো বন্ধু হে
বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো…
মেঘের মধ্যে মেঘ হয়ে যাই
ঘাসের মধ্যে ঘাস।।
বুকের মধ্যে হলুদ একটা
পাতার দীর্ঘশ্বাস।।
-----------------------------------------------
(২)
আজম খান
কথা- ধ্রুব এষ ( পপ সম্রাট গুরু আজম খানকে উৎসর্গ করে)
কন্ঠ- সৌর

আমি আমার মনে মনে
গাইছি একটা গান
আমি জানি এই গানটা
শুনছেন আজম খান।
আমার গানে ঘাসের কথা
পাতার কথা থাকে
হারানো দিন পুরনো রাত
ভাটার কথা থাকে।
আমার গানে আজম খানের
হাত ধরে দাড়ান
জিম মরিসন পিট সিজারের
সঙ্গে বব ডিলান।।

আমার গানের দরজা খোলা
থাকার কথা থাকে
শীতে একা রোদ্রের দুপুর
আঁকার কথা থাকে।
আকাশ ভরা সূর্য তারা
দৃশ্য ভরা প্রান
ফড়িং প্রজাপতির ডানায়
মায়া অফুরান।।

আমার গানে আমি টেনে 
আনি বাঁচ্চা তোকে 
টেনে আনি
জর্জ হ্যারিসন অঞ্জন দত্ত কে
কেউ না শুনুক আমি জানি
শুনছেন আমার গান
আমার ঘরে আমার পাশে
বসে আজম খান।।


আজম খান বাংলা ব্যান্ড এবং পপ সঙ্গিতের অবিসংবাদিত সম্রাট । তার মাধ্যমেই উন্মোচিত হয়েছিল এ সংগীতের এক অন্যধারা। দেশীয় পপগানের আকাশে তিনি ঘটিয়েছিলেন নতুন সূর্যোদয়। যে কারণে বাংলাদেশের পপসংগীতাঙ্গনের সব তারকা নির্দ্বিধায় ভালবাসা আর অসীম শ্রদ্ধায় তাকে বসিয়েছেন পপ সম্রাট গুরু আকাশসম সম্মানের আসনে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যার পুরো নাম ছিলো মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান । স্বাধীন দেশে গড়ে তোলেন ব্যান্ড উচ্চারন। জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, মৃত্যু নাই।
-----------------------------------
(৩)
তুমি দাঁড়াও আমার পাশে
কথা - ধ্রুব এষ (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সন্‌জীদা খাতুনকে উৎসর্কগ করে)
কণ্ঠ -সুদর্শনা অলকানন্দা কুন্ডু 

দাঁড়াও আমার পাশে
তুমি দাঁড়াও আমার পাশে
সকাল বেলার প্রথম আলো
পড়লো ঘাসে ঘাসে
তুমি দাঁড়াও আমার পাশে 

পাখিরা ডাক দিলো ওরে
পাহাড়ি দূরের শহরে 
পাখিরা ডাক দিলো ওরে
পাহাড়ি দূরের শহরে 
উড়ে বেড়ায় কারা কারা
অচিন কোন আকাশে 

সকাল বেলার প্রথম আলো 
পড়লো ঘাসে ঘাসে 
তুমি দাঁড়াও আমার পাশে 

কোন অরণ্যে মেঘের খেলা
ধুলো ওড়া সন্ধ্যাবেলা 
কোন অরণ্যে মেঘের খেলা
ধুলো ওড়া সন্ধ্যাবেলা
জোনাকিরা আলো ছড়ায় 
তারাদের উচ্ছ্বাসে 

সকাল বেলার প্রথম আলো 
পড়লো ঘাসে ঘাসে
তুমি দাঁড়াও আমার পাশে 
দাঁড়াও আমার পাশে 
তুমি দাঁড়াও আমার পাশে ।।


ধ্রুব এষ কথায়- সন্‌জীদা ম্যাডাম সব সময় বাঙালি সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছেন, কখনো বিচ্ছিন্ন হতে দেননি। তিনিই পাকিস্তান সরকারের বাধা অমান্য করে সংস্কৃতজনদের নিয়ে আয়োজন করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংস্কৃতিক উন্নয়নে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর মতো গুণী মানুষকে নিয়ে গান লিখতে পেরেছি ভেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। তাঁকে সম্মান জানিয়েই গানটি করা।

সন্‌জীদা খাতুন (৪ এপ্রিল ১৯৩৩ - ২৫ মার্চ ২০২৫) রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রাক্তন সভাপতি। তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
-------------------------------------------------
(৪)
আয় হিমু যাই
কথা : ধ্রুব এষ 
কণ্ঠ-  সৌর 

একা একা ফেরা মাতাল হাওয়া
দূরে কোথায় মেঘের ছায়া
কোথাও কেউ নেই এই পারাপার
শূণ্য যখন নামিবে আঁধার 
তোমাদের এই নগরে নিষাদ
আমার আছে জল আজন্ম স্বাদ
ফানুস উড়াই ফানুস উড়াই।

লিখে কোথায় চলে গেলেন
এমন করে কেউ কি যায়
চান্নি পসর রাত থাকে তার 
জন্য আজও অপেক্ষায় 
অপেক্ষাতে থাকে দূরে অচিনপুর আর ইস্টিশন 
দুই দুয়ারি তন্দ্রা বিলাস
দিনের শেষে নির্বাসন।

অপেক্ষাতে শ্যামল ছায়া
জলপদ্ম প্রথম প্রহর
তোরও কি মন খারাপ অনেক
মানুষটা কে ছিলেন তোর
তুই খালি পায় হাটছিস
পরে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি 
মনটা খারাপ না করে  
আয় রোদে হাঁটি আর ভাবি ।

না কোথাও যাননি তিনি
এই যে বসে অন্যদিন
সকাল বেলার রোদে লিখছেন 
ছায়াবীথি অন্তহীন 
মেঘ বলেছে যাব যাব
উড়াল পঙ্খী উড়েই যায়
তিনি লিখছেন, লিখছেন বলে
অন্ধকারের গান ফুরায়।

আয় তবে যাই
তার কাছে যাই
রোদে হেঁটে হেঁটে 
আয় হিমু যাই
আয় হিমু যাই
তার কাছে যাই
আয় হিমু যাই
আয় হিমু যাই 
---------------------------------------
(৫)
আহারে 
কথা : ধ্রুব এষ 
কণ্ঠ : রূপকথা 

তোদের জন্য আকাশের কিছু মেঘ এনে দিতে পারি 
আকাশে আমার বাড়ি আকাশে আমার বাড়ি 
তোদের জন্য আকাশের কিছু মেঘ এনে দিতে পারি 
আকাশে আমার বাড়ি আকাশে আমার বাড়ি 
আমি কে আমি কে 
কেউ একজন এমন একজন
থাকে যে আকাশে
আকাশে আকাশে
আমি কে আমি কে 
কেউ একজন এমন একজন
থাকে যে আকাশে
আকাশে আকাশে

তোদের জন্য সকালের কিছু রোদ এনে দিতে পারি
সকালে আমার বাড়ি
সকালে আমার বাড়ি
তোদের জন্য সকালের কিছু রোদ এনে দিতে পারি
সকালে আমার বাড়ি
সকালে আমার বাড়ি
আমি কে আমি কে
কেউ একজন এমন একজন 
থাকে যে সকালে
সকালে সকালে 

তোদের জন্য পাহাড়ের কিছু রঙ এনে দিতে পারি
পাহাড়ে আমার বাড়ি 
পাহাড়ে আমার বাড়ি 
তোদের জন্য পাহাড়ের কিছু রঙ এনে দিতে পারি
পাহাড়ে আমার বাড়ি 
পাহাড়ে আমার বাড়ি 
আমি কে আমি কে
কেউ একজন এমন একজন
থাকে যে পাহাড়ে 
পাহাড়ে পাহাড়ে 
আকাশে আকাশে 
সকালে সকালে 
পাহাড়ে পাহাড়ে
থাকি তবে আমি 
কেউ না কেউ না
কেউ না আমি কেউ না
কেউ না কেউ না
কেউ না আমি কেউ না
আহারে !
----------------------------------------
(৬)
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ
কথা : ধ্রুব এষ (কথাসাহিত্যিক ও লেখক বুলবুল চৌধুরী কে উৎসর্গ করে)
কণ্ঠ: সৌর

দাঁড়িয়ে আছেন 
অথবা হাঁটছেন
পুরনো গল্পের 
শব্দ কাটছেন 
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ 
ধোঁয়ার অন্তর্গত...

তার মাথার ভেতর
ঘুরে বিষয়
দলিলপত্র যত 
পৃথিবী ঘুরছে তিনিও ঘুরছেন 
চরকি ঘুরছে
তিনিও ঘুরছেন
লাটিম ঘুরছে
তিনিও ঘুরছেন
বসে বসে দেখি 
ঘুরছেন অবিরত 
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ 
ধোঁয়ার অন্তর্গত... 

কাছের দূরের 
নিকট পরের
আউপাতালি
ঘরের দোরের
আগন্তুকের মতো
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ 
ধোঁয়ার অন্তর্গত...

ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ
আপনি মানুষ নাকি ঘুড়ি
উড়তে থাকুন ঘুরতে থাকুন 
বুলবুল চৌধুরী । 


বুলবুল চৌধুরী (১৬ আগস্ট ১৯৪৮ - ২৮ আগস্ট ২০২১) কথাসাহিত্যিক ও লেখক। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। লেখালেখি ছাড়াও তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তার প্রকাশিত ছোট গল্পগ্রন্থগুলো হলো `টুকা কাহিনী`, `পরমানুষ`, `মাছের রাত` ও `চৈতার বউ গো`। তার উপন্যাসগুলোর তালিকায় আছে `অপরূপ বিল ঝিল নদী`, `কহকামিনী`, `তিয়াসের লেখন`, `অচিনে আঁচড়ি`, `মরম বাখানি`, `এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে`, `ইতু বৌদির ঘর` এবং `দখিনা বাও`। তার আত্মজৈবনিক দুটি গ্রন্থের নাম `জীবনের আঁকিবুঁকি` ও `অতলের কথকতা`। `গাঁওগেরামের গল্পগাথা`, `নেজাম ডাকাতের পালা`, `ভালো ভূত` আর `প্রাচীন গীতিকার গল্প` নামক কিশোর গ্রন্থের রচয়িতাও তিনি।
-----------------------------------------
(৭)
আর একটু পর
কথা: ধ্রুব এষ
কন্ঠ- অবন্তী সিঁথি

কিছু চেনা শোনা বৃষ্টির কণা,
বললো বৃষ্টি হবে আর একটু পর।
আর একটু পর, আর একটু পর
ভিজে যাবে কাগজের পাখিদের ঘর
বৃষ্টি হবে আর একটু পর।

ভিজে যাবে ফড়িং এর ডানা
ভিজে যাবে ড্রয়ইং এর খাতা,
ভিজে যাবে রঙ করা নদী
ভিজে যাবে রঙ করা পাতা।
আর একটু পর, আর একটু পর
ভিজে যাবে কাগজের পাখিদের ঘর
বৃষ্টি হবে আর একটু পর।

ভিজে যাবে আকাশের রং
ভিজে যাবে পাহাড়ের রেখা,
ভিজে যাবে কোনো দূরে কেউ
আর একটু পর শুধু একা একা।
আর একটু পর, আর একটু পর
বৃষ্টি বৃষ্টি হবে আর একটু পর
বৃষ্টি হবে আর একটু পর।

কিছু চেনা-শোনা বৃষ্টির কণা,
বললো বৃষ্টি হবে আর একটু পর।
আর একটু পর, আর একটু পর
ভিজে যাবে কাগজের পাখিদের ঘর
বৃষ্টি হবে আর একটু পর।
বৃষ্টি হুঁ…
---------------------------------------------------
(৮)
পাখি আঁকি পাখি বানাই
কথা: ধ্রুব এষ
কন্ঠ- নীল স্রোতস্বিনী ও ঋভু রোদ্দুর

পাখি আঁকি পাখি বানাই
পাখি উড়াই ঘরে
মনে মনে হারিয়ে যাই
রঙ্গিন তেপান্তরে।।

রঙ্গিন মাঠে রঙ্গিন ফুলে
প্রজাপতি ভেঙ্গে বসে থাকে
মেঘ রাঙা সব 
মস্ত মোষের সিংয়ে।।

কাকতাড়ুয়া কাক 
জয়েন করে পোলাপান
কেউ চেঁচিয়ে উঠে বলে
এই হচ্ছে গান।।

সব কিছু ঠিক আছে
সব হলেও ভুল
কাছের দূরের বন্ধুর জন্য
আমরা বানাই ফুল।।

আমরা আঁকি পড়ি লিখি
যা মনে হয় গাই
ইকড়ি মিকড়ি পাতায় 
রঙিন পৃথিবী বানাই।। 


--- বাউল পানকৌড়ি

মন্তব্যসমূহ