মুঘল জলদুর্গ - সোনাকান্দা দূর্গ নারায়ণগঞ্জ


বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা হলে রাজধানী জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকা) কে মগ ও পর্তগীজ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার সমর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনটি জলদূর্গ  নিমার্ণ করেছিলো। এর অন্যতম ছিলো শীতালক্ষা নদীর পূর্বতীরে সোনাকান্দা জলদূর্গ। বাকি দুটা একটা মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর কেল্লা অন্যটা নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ কেল্লা। সোনাকান্দা দুর্গ এর নির্মাণকালের সঠিক সাল ও তারিখ না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে বাংলার সুবেদার মির জুমলার সময় নির্মিত হয়েছিলো। 

এই দূর্গের নামকরন নিয়ে একটি কিংবদন্তির রয়েছে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসে বাংলার বিজয়ের জন্য সুবেদার নিযুক্ত করেছিলেন ইসলাম খান কে। বাংলার বার ভূইয়াদের মুঘল শাসনে নিয়ে আসা ছিলো তার প্রথম দায়িত্ব। সুবেদার ইসলাম খান এর রনকৌশলে বাংলা বার ভূইয়ারা মুঘলদের শাসন স্বীকার করে নিতে বাধ্য হোন। এই দূর্গ তখন বার ভূইয়াদের প্রধান ঈশা খাঁ দেখা শোনার দায়িত্বে ছিলেন। কারন তাঁর রাজধানী সোনাগাঁর এ দূর্গের খুব কাছে অবস্থিত। জনশ্রতি আছে, বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জ) জমিদার কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ী সকলের সাথে শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসল করতে এসে জলদস্যুদের হাতে বন্দি হোন । 
অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংবাদ ঈসা খাঁর কাছে পৌঁছে যায়। ঈসা খাঁর সৈনিকদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণময়ীকে দস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করে সোনাকান্দা দুর্গে নিয়ে আসেন। মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য জমিদারকে খবর পাঠায়। হিন্দু জমিদার মেয়েকে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এই কারনে মুসলিমদের হাতে খাবার খেয়েছে হেনতেন সেই উচ্চ হিন্দুদের যেভাবে জাত যায় বলতো। স্বর্ণময়ী রূপবতী হবার কারনে ঈশা খাঁ সাহেবের ভাল লেগে যায়। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে তিনি স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করেন এবং নতুন বিবাহিত স্ত্রীর নাম রাখেন সোনাবিবি। জনশ্রুতিও আছে েজমিদার কেদার রায় কন্যাকে গ্রহণ না করায় কন্যা স্বর্ণময়ী দু রাত কান্নাকাটি করেই কাটান। ঈশা খাঁ সাহেব সোনাবিবিকে খুবই ভালবাসতেন এবং সেই কান্না স্মৃতি মনে করিয়ে দিতেই এই কেল্লার নাম রাখেন সোনাকান্দা যার অর্থ বলা যায় সোনাবিবির কান্না। 


এই দুর্গ সঠিক নির্মাণের সাল তারিখ কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায়নি তবে ঐতিহাসিকদের মতে এটি ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। চতুর্ভুজাকৃতির এ দুর্গ আয়তনে ৮৬.৫৬ মি ৫৭.০ মি এবং ১.০৬ মি পুরু দেওয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত যার উচ্চতা ৩.০৫ মি। দেওয়ালের তলদেশ নিরেটভাবে তৈরি। বৃত্তাকার কামান স্থাপনা মঞ্চটির পশ্চিম দিকে সিঁড়ি আছে, যা উত্তোলিত মঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ উঁচু মঞ্চে প্রবেশের জন্য পাঁচ খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ রয়েছে। কামান স্থাপনার উঁচু মঞ্চে শক্তিশালী কামান নদীপথে আক্রমণকারীদের দিকে তাক করা থাকত। এটি মুগল জলদুর্গের একটি নতুন বৈশিষ্ট্য।

মঞ্চটিতে দুটি বৃত্তাকার অংশ আছে, অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের অংশটি যথাক্রমে ১৫.৭০ মি এবং ১৯.৩৫ মি ব্যাস বিশিষ্ট। মঞ্চটি ৬.০৯ মি উঁচু এবং বেষ্টনীপ্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম পার্শ্বের কোণার বুরুজগুলি পূর্বপার্শ্বস্থ বুরুজগুলি অপেক্ষা অধিক প্রশস্ত। পূর্ব বুরুজের ব্যাস ৪.২৬ মিটার এবং পশ্চিম অংশের দুটি বুরুজের ব্যাস ৬.৮৫ মিটার।

দুর্গটিতে দুটি প্রধান অংশ আছে। একটি অংশ বিশাল আয়তনের মাটির ঢিবিসহকারে গঠিত দুর্গপ্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত, যার মধ্যে গোলা নিক্ষেপের জন্য বহুসংখ্যক প্রশস্ত-অপ্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। অপর অংশটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, যা দুর্গের অভ্যন্তরে পশ্চিমাংশে নির্মিত। সুরক্ষিত দেওয়ালের অভ্যন্তরে উঁচু মঞ্চটি ব্যতীত আর কোন স্থায়ী ইমারতের সন্ধান পাওয়া যায় নি। দুর্গপ্রাচীরের সর্বত্র গুলি ছোড়ার ব্যবস্থাসহ মারলোন দ্বারা সজ্জিত; এ মারলোনগুলির গড় উচ্চতা ১ মিটার।

দুর্গটিতে প্রবেশের জন্য উত্তর দিকে একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। খিলানযুক্ত এ প্রবেশপথ একটি আয়তাকার ফ্রেমে আবদ্ধ এবং উভয়দিক পলেস্তরায় বিভিন্ন আকৃতির প্যানেল নকশায় সজ্জিত। প্রবেশপথের মূল খিলান ছিল চতুষ্কেন্দ্রিক এবং চার কোণায় রয়েছে চারটি পার্শ্ববুরুজ। হাজীগঞ্জ এবং ইদ্রাকপুরের দুর্গ প্রাচীরের পার্শ্ববুরুজগুলির সাথে এ দুর্গের পার্শ্ববুরুজগুলির মিল নেই। সোনাকান্দা দুর্গের পার্শ্ববুরুজগুলি অষ্টভুজাকার।

ঐতিহাসিক এই জলদূর্গটির অবস্থান ঢাকার খুব কাছে। দিনে গিয়ে দিনেই চলে আসা যায়। ঢাকা থেকে সড়ক পথ বা রেলপথে প্রথমে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরে।  ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাবার বাসা ছাড়ে বায়তুল মোকারকম মসজীদের সামনে থেকে। সিটি বন্ধন বা উৎসব বাস শার্ভিসে ভাড়া জনপ্রতি ৫০টা। এসি  বাস রয়েছে ভাড়া ৮০ টাকা। ট্রেনে ভাড়া খুবই কম ২০ টাকা মাত্র। শহরে নেমে চলে আসতে হবে লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায়। সেখানের ২নং লঞ্চ ঘাট থেকে েনৌকা বা ট্রলারে নদীর পার হয়ে ওপারে গেলেই নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলা। সেখান থেকে রিক্সা বা অটোতে অল্প সময়েই সোনাকান্দা দূর্গে যাওয়া যায়। সময় নিয়ে গেলে ঘুরে আসতে পারেন সোনারগাঁও এবং পানাম নগর থেকে। 


----- বাউল পানকৌড়ি

মন্তব্যসমূহ