হাজীগঞ্জ দূর্গ মুঘল জলদূর্গের একটি- নারায়ণগঞ্জ

বাংলার মুঘল শাসনের শুরু সময়ে রাজাধানী ঢাকাকে মগ ও পর্তগীজ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার সমর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই দূর্গটি নির্মান করা হয়েছিলো। নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ দূর্গ, সোনাকান্দা দূর্গ এবং মুন্সিগঞ্জের েইদ্রাকপুর কেল্লাকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল। পূর্বে হাজিগঞ্জ দূর্গের নাম ছিলো খিজিরপুর দুর্গ। শীতালক্ষা নদীর ঠিক পশ্চিম দিকেই এই দূর্গটির অবস্থান। 

 

চতুর্ভুজাকৃতির এই দুর্গের পঞ্চভুজি বেষ্টন-প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি চালাবার উপযোগী ফোকর এবং চারকোণে গোলাকার বুরুজ। প্রাচীরের চারদিকে অভ্যন্তরভাগে দেয়ালের ভিত থেকে ১.২২ মিটার উঁচুতে রয়েছে চলাচলের পথ এবং এর দেয়ালেও আছে গুলি চালাবার উপযোগী ফোকর। চারকোণের প্রতিটি বুরুজের অভ্যন্তরভাগে দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়ি এবং এর বপ্র বহির্গত অংশে রয়েছে বন্দুকে গুলি চালাবার প্রশস্ততর ফোকর। দুর্গের চতুর্ভুজাকৃতির অঙ্গনের এক কোণে রয়েছে ইটের তৈরি একটি সুউচ্চ চৌকা স্তম্ভ। এটি সম্ভবত একটি পর্যবেক্ষণ বুরুজ। এই স্তম্ভের অবস্থান থেকেই দুর্গটিকে সমসাময়িক অপরাপর জলদুর্গের সমগোত্রীয় বলে ধরে নেয়া যায়। কামান বসানোর উপযোগী উঁচু বেদীর অবস্থান দুর্গটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

নদীর দিকে দুর্গের একমাত্র প্রবেশপথ থেকে বোঝা যায় যে, শুধুমাত্র নদীপথেই দুর্গের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। ফটকটির আয়াতাকার কাঠামোতে রয়েছে পঞ্চভূজি প্রবেশপথ। প্রবেশপথের দু’পাশে রয়েছে খোদাই করা আয়তাকার খিলান এবং এর শীর্ষভাগ পদ্মফুলের অলঙ্করণ শোভিত। দুর্গের অভ্যন্তরে অপর কোনো নির্মাণ কাঠামো না থাকায় প্রতীয়মান হয় যে, বর্ষা মৌসুমে যখন জলদস্যুদের আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিত কেবলমাত্র তখনই দুর্গটিতে সৈন্য মোতায়েন করা হতো এবং সৈন্যরা সেখানে তাঁবুতে আশ্রয় নিত। হাজীগঞ্জ দুর্গটি সম্পূর্ণ ইট দ্বারা নির্মিত এবং প্লাস্টার দ্বারা আচ্ছাদিত। দুর্গটিতে বৃত্তাকার ছয়টি বুরুজ রয়েছে। যার তিনটি বেশ বড় ও সমমাপের এবং বাকি তিনটি তুলনামুলক ভাবে ছোটও সমান । পাঁচ কোণাকারে নির্মিত এই দুর্গের বাহুগুলো এক মাপের নয় এবং পূর্ব পশ্চিমে লম্বা দুর্গটির আয়তন আনুমানিক ২৫০ বাই ২০০ ফুট। দুর্গের কোণগুলোতে কামান বসানোর জন্য যে বুরুজ নির্মাণ করা হয়েছিল। দক্ষিণ পূর্ব কোণের বুরুজের সামনে একটি সাত ধাপের পিরামিড কামান প্লাটফর্ম রয়েছে। দুর্গের দেয়ালগুলো বেশ উঁচু প্রায় ২০ ফুট এবং পুরু । 

সমগ্র দুর্গ প্রাচীর এবং বুরুজ অসংখ্য বড় বদ্ধ পদ্মপাপড়ি নকশার merlons দ্বারা সুশোভিত। দুর্গ প্রাচীর লাগোয়া একটি পায়ে হাঁটার উপযোগী প্রাচীর রয়েছে দুর্গের উত্তর দেওয়ালের মাঝ বরাবর এর একমাত্র প্রবেশ পথ বা দুর্গ তোরণটি অবস্থিত। দুর্গ তোরণটির উপরিভাগ পদ্মপাপড়ি নকশা সজ্জিত করা। কিছুটা উঁচু এই দুর্গের প্রবেশ তোরণের বাইরের দিকে প্রায় ১৮টি ধাপের সিঁড়ি রয়েছে। আবার তোরণ থেকে দুর্গ চত্বরের ভেতরে নামতে রয়েছে সিঁড়ির ৮টি ধাপ। দুর্গের পূর্ব দক্ষিণ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম কোণায় দুটি বুরুজ জায়গা আছে। আরও একটি বুরুজ রয়েছে দক্ষিণ পাশে। তাছাড়াও উত্তর ও পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম কোণায় ছোট দুটি বুরুজ অংশ আছে যেখানে এক সাথে কয়েকজন বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাতে পারত। দুর্গের পূর্ব ও দক্ষিণ কোনে রয়েছে চৌকো একটি ওয়াচ টাওয়ার বা স্তম্ভ। এই স্তম্ভের অবস্থান থেকেই দুর্গটিকে সমসাময়িক অপরাপর জলদুর্গের সমগোত্রীয় বলে ধরে নেওয়া যায়। এখন এটি ধ্বংসপ্রায় হলেও টাওয়ারে ঢোকার জন্য একসময় এতে ছিল ছোট্ট একটি পূর্বমুখী দরজা আর ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি মোটা গোল পিলার লাগোয়া ঘোরানো সিঁড়ি। শত্রুদের ওপর নজর রাখার জন্য এই ওয়াচ টাওয়ারটি ছাড়া দুর্গের ভেতর আর কোনো স্থাপনার অস্তিত্ব নেই। এবং সম্ভবত এখানে তেমন কোনো স্থাপনা কখনো ছিলও না। তার ফলে সৈন্যরা এখানে তাবু ফেলে অবস্থান করত বলেই ধারণা করা হয়।  ১৯৫০ সালে এই হাজীগঞ্জ কেল্লাটিকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত করে বিভিন্ন ধাপে সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেয়া হয়। 

ঐতিহাসিক এই জলদূর্গটির অবস্থান ঢাকার খুব কাছে। দিনে গিয়ে দিনেই চলে আসা যায়। ঢাকা থেকে সড়ক পথ বা রেলপথে প্রথমে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাবার বাসা ছাড়ে বায়তুল মোকারকম মসজীদের সামনে থেকে। সিটি বন্ধন বা উৎসব বাস শার্ভিসে ভাড়া জনপ্রতি ৫০টা। এসি বাস রয়েছে ভাড়া ৮০ টাকা। ট্রেনে ভাড়া খুবই কম ২০ টাকা মাত্র। শহরে চাষাড়া নেমে রিকশা বা ইজিবাইকে হাজীগঞ্জ দুর্গ দেখতে যেতে পারবেন। এর খুব কাছেই ঐতিহাসি কেল্লার পুল এবং বিবি মরিয়মের সমাধি। নদী পার হলেই নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা। সেখান থেকেও ঘুরে আসা যায়। আছে কদম রসূল দরগা মসজিদ ও মাজার, সোনাকান্দা দূর্গ আর প্রাচীন বন্দর শাহী মসজিদের মত প্রাচীন স্থাপনা। শেষ বিকেলের আগে ইচ্ছে হলে চলেও যেতে পারেন ঐতিহাসিক নগরী পানাম থেকে। 


---- বাউল পানৈকৌড়ি

মন্তব্যসমূহ