মরমী কবি আব্দুস সাত্তার মোহন্ত-- আমি তো মরে যাবো রেখে যাবো সবি
আব্দুস সাত্তার মোহন্ত একজন বাংলাদেশী মরমী কবি, বাউল সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। বাউল গান তথা পল্লীগান যাদের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে আব্দুস সাত্তার মোহন্ত তাদের মধ্যে অন্যতম।
আব্দুস সাত্তার মোহন্ত (জন্ম নভেম্বর ৮, ১৯৪২ - মৃত্যু মার্চ ৩১, ২০১৩) একজন বাংলাদেশী মরমী কবি, বাউল সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। বাউল গান তথা পল্লীগান যাদের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে আব্দুস সাত্তার মোহন্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। গুরুপ্রেম, ঐশী প্রেম, প্রার্থনা, মুর্শেদী, দেহতত্ত্ব, আধ্যাতিকসহ তিনি প্রায় ৬ শতাধিক গান রচনা করেছেন। তিনি তার রচিত বিভিন্ন জনপ্রিয় গান বিশেষ করে তার অমর সৃষ্টি আমি তো মরে যাবো চলেই যাবো গানের জন্য দেশ বিদেশে খ্যাত। এছাড়াও তার বহু গান জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার বেশ কিছু গান চলচ্চিত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে।
আব্দুস সাত্তার মোহন্ত ১৯৪২ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কুড়িগাঁও গ্রামে একটি সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম গোলাম আলী বেপারী এবং মাতা মরহুমা সবুরুন নেছা। ছয় ভাই বোনের বিশাল পরিবারে বেশিদূর লেখাপড়া করা সুযোগ পাননি। জীবিকার জন্য দিঘলী বাজারে ভাড়া নেন একটি ছোট্ট দোকান। আর রাতে ঘুমাতেন বাজার সংলগ্ন ছত্তর বেপারী সাহেবের বাড়িতে। সে বাড়িতে থাকতেন বিখ্যাত সাধক কদম আলী মস্তান । তার আস্তানায় সবসময় লোকজনের আনাগোনা থাকতো। আর রাতে বসতো গানের আসর। প্রায়ই নামী-দামী আসতেন গান করতে। সেই আস্তানাতেই পাগল কদম আলী মস্তানের উৎসাহে আব্দুস সাত্তার মোহন্ত গান বাজনা শুরু করেন। কদম আলী মস্তানই তার "মোহন্ত" নামটি প্রদান করেন। আব্দুস সাত্তার মোহন্ত ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ রেডিওতে গান করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে গান পরিবেশন করেছেন। ১৯৮৯ সালে তার প্রথম অডিও অ্যালবাম আমিতো মরে যাবো প্রকাশিত হয়। সাত্তার মোহন্ত ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার নির্বাচিত হোন।
আমি তো মরে যাবো
চলে যাবো রেখে যাবো সবি
আছোস নি কেউ সঙ্গের সাথী
সঙ্গে নি কেউ যাবি
আমি মরে যাবো
মরার সঙ্গে সঙ্গে
পড়ে যাবে কান্নাকাটির ভিড়
সবাই মোরে মাটি দিতে হইবে অস্থির
আমায় দেবে মাটি
আমায় দেবে মাটি
ভুল ত্রুটি চেয়ে নেবে ক্ষমা
কেউবা এসে হিসাব করবে
কোন ব্যাংকে কি জমা
আমি মরে যাবো
মরে যাবো রেখে যাবো
দুনিয়ার সম্পদ
সেই সম্পত্তি ডেকে আনবে
আপদ আর বিপদ
সম্পদ ভাগের জন্য
সম্পদ ভাগের জন্য
মন মালিন্য হবে সুত্রপাত
একজনকে করবে আরেকজন
আঘাত অপবাদ
আমি মরে যাবো
গানের ছন্দে মন আনন্দে
মাথা ঝোলাও তালে
বুঝলি না কি অন্ধ মানুষ
গায়কে কি বলে
সবার হাতে ধরি
সবার হাতে ধরি পায়ে পড়ি
বেঁধে নাও সামান
কিতাবে কয় ওপারের ডাক ভয়ঙ্কর নিদান
আমি মরে যাবো
মরমী বাউল কবি আব্দুস সাত্তার মোহন্ত'র ওফাৎ দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর ৩০ ও ৩১শে মার্চ তারিখে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কদমপুরের "মঞ্জিল-এ-মোহন্তে" ২দিন ব্যাপী আয়োজিত হয় "মোহন্ত উৎসব"। মোহন্ত'র লেখা গান পরিবেশন করবেন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বাউল শিল্পীরা।
"দ্বার খুলে দাও দয়াল আমি তোমার দয়ার ভিখারি
তাড়াইয়া দিও না দয়াল কাতরে বিনয় করি!!"
গানকে তিনি জীবনের চেয়ে ও বেশি ভালবাসতেন। সারাজীবন গানের মাঝেই বিচরণ করেছেন। শেষ বয়সে এসে ও সপ্তাহে কমপক্ষে ৩/৪ রাত তাকে গান করতে হত। তিনি গান লিখেছেন, সুর করেছেন আবার নিজেই গেয়েছেন। এমন বহুমাত্রিক প্রতিভা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। মোহন্ত'রা সবসময় জন্মে না।
তিনি ছিলেন সংগীত স্রষ্টা। আমাদের বাউল গানের ভান্ডার যাদের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে- আব্দুস সাত্তার মোহন্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। গুরুপ্রেম, ঐশীপ্রেম, প্রার্থনা, মুর্শেদী, দেহতত্ত্ব, আধ্যাতিকসহ তিনি প্রায় ৯ শতাধিক গান রচনা করেছেন। তার রচিত অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তার অমর সৃষ্টি "আমি তো মরে যাবো চলেই যাবো" গানের জন্য তিনি দেশ বিদেশে পরিচিত । এছাড়াও তার বহু গান জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার বেশ কিছু গান চলচ্চিত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে।
"যৌতুক প্রথা বন্ধ কর ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ো
যৌতুক চাইলে তারেই ধর
জন্মেরই মতন রে!!"
"যে ব্যথা দিয়েছরে বন্ধু আমার অন্তরে
আমার মন জানে আর আমি জানি
অন্যে কি বুঝিতে পারে?"
"ভবমায়ার জেলখানাতে
আমি এক দাগী আসামী
পরবাসের হাজতবাসে
বন্দী হইয়াছি আমি!!"
গানের মাধ্যমে প্রথম রেডিও বাংলাদেশে গান করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে গান পরিবেশন করেছেন।
১৯৮৯ সালে তার প্রথম অডিও অ্যালবাম "হুশিয়ার তোমরা হুশিয়ার" প্রকাশিত হয়। এই এলবামের আমি তো মরে যাবো, যৌতুক প্রথা বন্ধ করো, হঠাতে নিও না কেউ সিদ্ধান্ত এবং কি হইলো ঘোরকলির কালে গানগুলো ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সাত্তার মোহন্ত ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার নির্বাচিত হোন।
২০১২ সালের বইমেলায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আমি তো মরেই যাব" প্রকাশিত। প্রখ্যাত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন বইটির মোড়ক উন্মোচিত করেন। ২০২১ সালের বইমেলায় তার কাব্যগ্রন্থ "আমি তো মরেই যাব" ২য় খন্ড প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা বহু জনপ্রিয় গান মানুষের মুখেমুখে। তিনি মনেপ্রাণে একজন শিল্পী ছিলেন। গান গেয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়। শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন কন্ঠের যাদুতে। জীবন থেকে গানকে কখনো আলাদা করেন নি। গান গেয়ে মানুষকে কাঁদাবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। তিনি মানুষকে যেমন ভালবাসতেন তেমনি, মানুষের ভালবাসায় শিক্ত হয়েছিলেন। সারাটি জীবন গান আর গানের মানুষদের উপকার করেছেন। বাউল শিল্পীদের প্রতি তিনি ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। "সবাই তো হেসেছে তোমার জন্ম আনন্দে ,এমন এক জীবন গড়ো, মৃত্যুতে সবাই যেন কাঁদে!!"
২০০০ সালে প্রকাশিত দাগ থেকে যায় মিক্সড অ্যালবামে শিল্পী মেহেদির কন্ঠে আব্দুস সাত্তার মহোন্ত এর লেখা কালজয়ী গান আমি তো মরে যাবো ঐ সমেয়ে সারা দেশে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।
এই মহান শিল্পী ২০১৩ সালের ৩১শে মার্চ সবাইকে কাঁদিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন