সুলতানি স্থাপত্যের নিদর্শন বাবা আদম শহীদ (র.) মসজিদ- দরগাবাড়ী মসজিদ মুন্সিগঞ্জ
বাবা আদম মসজিদ বাংলার সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এটি ষড়গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ, যা সে সময়ের মুঘল-পূর্ব মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট, প্রস্থ ৩৬ ফুট। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৪ ফুট। গঠনশৈলীতে উত্তর-দক্ষিণে লম্বাকৃতির, সামনের দিকে খিলান আকৃতির। প্রধান প্রবেশপথ জানালা আছে। প্রধান প্রবেশপথের দু পাশে দুটি জানালা থাকলেও, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কোনো জানালা নেই, ফলে ভেতরে দিনের বেলাতেও স্বল্প আলো প্রবেশ করে। মূল প্রবেশপথের ওপর ফারসি অক্ষরে খোদাই করা কালো পাথরের শিলালিপির কারুকাজ আছে। খিলান দরজার স্তম্ভের পাদদেশ, মাঝামাঝি এবং কার্নিশের নিচে পাতলা ইট কেটে সুলতানি স্থাপত্যের নকশা প্রবেশপথের দুই পাশে এবং দেয়ালের বিভিন্ন অংশে সুদৃশ্য ইটের ফলকে নকশা মসজিদের চার কোণায় ষড়ভূজ আকৃতির স্তম্ভ রয়েছে, যা মসজিদটিকে দূর থেকে একটি সুরক্ষিত দুর্গের মতো দেখায়।
পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধ্ববৃত্তাকার মেহরাব। সামনের দেয়ালে ধনুকাকৃতির খিলানবিশিষ্ট তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। মাঝের প্রবেশ পথের দুই পাশের উপরিভাগ সুন্দরভাবে খাঁজকাটা রয়েছে। মসজিদের চমৎকার দুইটা মারবেল পাথড়ের নির্মিত দুটি স্তম্ভ রয়েছে। এই দুই স্তম্ভ ব্যাচ করে পূর্ব পশ্চিমে দুই সাড়িতে এবং উত্তর দক্ষিনে তিন সাড়িতে বিভিক্ত। স্তম্ভ দুটি মাঝ থেকে চার ফুট পর্যন্ত অষ্টকোণাকৃতির এবং এর পর থেকে ষোলকোণাকৃতির। স্তম্ভের চারপাশের দেয়ালর উপরই মসজিদটি
অর্ধবৃত্তকার ছয়টি গম্বুজ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রধান মেহরাব এবং এর পাশে দুইট মেহরাব ও পাশের দেয়াল ফুল-লতাপাতা, জ্যামিতিকি নক্সা, পোড়ামাটির কারুকাজে সমৃদ্ধ। বাবা আদম ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক, যিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ১১৭৩ সালে তৎকালীন বিক্রমপুর পরগনার রামপালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন। সে সময় বাংলার সেন রাজবংশের শাসন চলছিল এবং এখানে হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল প্রবল। ইসলাম প্রচারের জন্য বাবা আদম বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং শহীদ হয়েছিলেন।মসজিদটির এর কয়েক গজ পূর্বে একটি মাজার আছে। মাজারটি ইটের তৈরী ২৫ (পঁচিশ) ফুট বাহুবিশিষ্ট বর্গাকার আয়তনের মঞ্চের উপর একটি পাকা সমাধি বিশেষ। এই মসজিদটির আরেক নাম দরগাবাড়ী মসজিদ এবং মাজারটিকে বাবা আদমের দরগা নামেরই পরিচিত।
স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রচলিতি এক কাহিনী জানা যায়, একটি জনপ্রিয় কাহিনি অনুযায়ী, রাজা বল্লাল সেন যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার পোষা কবুতর সঙ্গে নিয়ে যান, পরিবারের সদস্যদের বলে যান, যদি কবুতর ফিরে আসে, তবে বুঝতে হবে তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তারা যেন আত্মাহুতি দেয়। তবে যুদ্ধে রাজার জয় হলেও, ভুলক্রমে কবুতরটি উড়ে গিয়ে প্রাসাদে পৌঁছে যায়। ফলে রাজপ্রাসাদের নারীরা আত্মাহুতি দেন, যা ঐ সময়ের সামাজিক রীতির এক করুণ চিত্র তুলে ধরে। যুদ্ধে বাবা আদম শহীদ হন। তার আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে এবং ইসলাম প্রচারের ইতিহাস সংরক্ষিত রাখার জন্য, তার মৃত্যুর প্রায় তিন শতাব্দী পর ১৪৮৩ সালে সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের শাসনামলে মালিক কাফুর এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এবং মসজিদের নাম রাখা হয় বাবা আদমের নামে। মসজিদটিতে এখনো নিয়মিত নামাজের জামায়াত হয়ে থাকে। স্থান স্বল্পতার কারণে সামনের প্রাঙ্গণে কংক্রিট ঢালাই করা হয় এবং প্রাঙ্গণসহ মসজিদ ভবনটি নিচু লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা।
আরেকটি প্রচলিত মিথ হচ্ছে এই দুইটি পিলার বা স্তম্ভের উপর তৈরি করা এই মসজিদরে সেই পিলার দুটি গরমের সময় ঘামে এবং আরেকটা প্রচলিত আছে এই পিলার দুটিকে নদীতে ভাসিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়। কথিত আছে এই মসজিদ নির্মানে তেঁতুল মিশ্রিত পানি দিয়ে ইট বালির মিশ্রন তৈরি করা হয়েছিল। এজন্য অনেকেই একে তেঁতুল পানির মসজিদ বলে। এই মসজিদের এক সময় মানত করা হতো। কথিত আছে হিন্দু মুসলিম দুইই সম্প্রদায়ই সমান ভক্তি নিয়ে এখানে মানত করতেন।

ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের সড়কপথে দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। তবে আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে আসতে হবে এই মাজারে আসার জন্য। আপনি চাইলে ঢাকা হতে সকালে এসে মাজার জিয়ারত ও মসজিদ দর্শন করে বিকেলেই ঢাকায় ফিরে যেতে পারবেন। সড়কপথে যেতে খুব একটা বেগ পোহাতে হবে না, তবে এটা ঠিক যে নৌপথে গেলে সময়ও বাচঁবে এবং যানজট এড়িয়ে নদী পথের সৌন্দর্য অবগাহন করে স্বাচ্ছন্দের সাথে পৌছানো যাবে। সদর ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জ গামী লঞ্চে সর্বোচ্চ দুই ঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাওয়া যাবে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা হতে রিক্সায় দরগাবাড়ি হযরত বাবা আদম শহীদ (র.) এর মাজার সংলঘ্ন মসজিদ এ যাওয়া যায়।
--- বাউল পানকৌড়ি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন