মাংকিপক্স বা এমপক্স রোগ- কি এর লক্ষণ ও অন্যান্য

বিশ্বে প্রথম ১৯৫৮ সালে বাঁদরের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল । ১৯৭০ সালে কঙ্গোতে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। তারপর থেকে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বাঁদরের মধ্যে এই রোগ প্রথম চিহ্নিত হওয়ার মাংকিপক্স নাম রাখা হয়। নাম শুনে বানরের কথা মনে হলেও মাংকিপক্স ভাইরাসটি পাওয়া যায় ইঁদুরের শরীরে। ভাইরাসটির প্রাকৃতিক আবাসভূমি পশ্চিম আফ্রিকার আক্রান্ত ইঁদুরের সংক্রমণ থেকে প্রথম ছড়ায়। আক্রান্তদের ত্বকে বসন্তের মতো দেখা দেয়। ফোস্কার মতো তৈরি হয়ে ফেটে যায় এবং চামড়া উঠতে থাকে। ২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাংকিপক্সের নাম বদলে রাখে 'এমপক্স' । প্রাথমিক ভাবে এই রোগের প্রকোপ বাঁদরের মধ্যে দেখা গেলেও এই রোগে মানুষও অনান্য পশুপাখি সংক্রমিত হতে পারে সেজন্যই মাংকিপক্স নাম পরিবর্ত ন করে এই রোগের নামকরন করা হয়ছে এমপক্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) হঠাৎ মাংকিপক্সের সংক্রামন বৃদ্ধির কারনে ১৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বৈঠকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি জরুরি অবস্থা জারি করেছে ।

মাংকিপক্স বা িএমপক্স

মাংকিপক্স বা এমপক্স কি : 

মাংকি পক্স বা এমপক্স হচ্ছে ভাইরাসজনিত প্রাণিবাহিত রোগ। রোগটি ছড়ায় মাংকি-পক্স নামক এক ধরনের ভাইরাসের মাধ্যমে। মাংকি-পক্স একটি ভাইরাসের নাম MPV অর্থাৎ Monkey Pox Virus, যা Orthopoxvirus গণের সদস্য। মাংকি-পক্স অনেকটাই জল বসন্তের মতো তবে এর সংক্রামক ও ক্ষতিকারক দিকের প্রভাব কম। এটি কোন প্রাণঘাতী ভাইরাস নয়।

১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি ল্যাবে বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ রোগ শনাক্ত হয় এবং এই কারণে নামকরণ করা হয় মাংকি পক্স। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জানতে পারে এই রোগের জন্য একমাত্র বানর দায়ী নয় অন্য পশুপাখির থেকেও ছড়াতে পারে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব ১৯৭০ সালে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে দেখা যায়। বর্তমানে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। শিশুদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। 

মাংকিপক্সের লক্ষণ:
  • জ্বর, মাথাব্যাথা, পেশিতে ব্যাথা।
  •  জ্বর আসার কিছুদিনের মধ্যে শরীরের যে কোন স্থানে ফুসকুড়ি উঠতে শুরু করা।
  • এটি দেখতে গুটির মতো হয়ে থাকে এবং প্রচুর চুলকায় এরপর একটা পর্যায় গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে।
  • প্রথমে মুখ থেকে শুরু হয় ফুসকুড়ি উঠা পরবর্তীতে আস্তে আস্তে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়াতে শুরু করে।
  • অনেক বিরল তবে এই রোগ যৌনাঙ্গে অথবা চোখেও দেখা যায়। আর যদি এটি চোখে হয় তবে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
  • ফুসকুড়িগুলো শুরুর দিকে হাল্কা চ্যাপ্টা দাগের মতো দেখা যায়, পরে ভিতরে তরল জমতে শুরু করে ফলে ফুসকুড়িগুলো ফুলে উঠে। শুরুর দিকে ফুসকুড়িগুলো বর্ণহীন হলেও পরে তা হলুদ হয় এবং ফুসকুড়িগুলো নিজে থেকেই ফেটে শুকিয়ে যায়। পরবর্তীতে কালচে হয়ে যায় আর এই দাগগুলো রয়ে যায়।
  • রোগটি ৪/৫ সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকে সেরে যায়।
মাংকিপক্সে যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন:
  • সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক, সরাসরি সংস্পর্শ কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি এসে কথা বলা বা শ্বাস নেয়ার মতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এটি একজনের থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে।
  • এই ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাস, নাক , মুখ, চোখ, ত্বকের যে কোন ক্ষত দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে।
  • সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক, সরাসরি সংস্পর্শ কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি এসে কথা বলা বা শ্বাস নেয়ার মতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এটি একজনের থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে।
  • বানর, ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো কোনো প্রাণী যদি এতে সংক্রমিত হয় আর কেউ যদি ওই সংক্রমিত প্রাণীর সঙ্গে বেশি কাছাকাছি আসে তবে তিনি এতে আক্রান্ত হতে পারেন।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা জিনিস ব্যবহার করলে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির খাওয়া খাবার খেলে।
 

মাংকিপক্স থেকে যেভাবে নিরাপদ থাকতে পারেন: 
  • বায়ু দূষণ ও বাতাসে এমপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে নিয়মিত মাস্ক ও চশমা ব্যবহার করুন।
  • অপরিষ্কার হাতে মাস্ক, ত্বক ও চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
  • নিয়মিত হাত পরিষ্কার রাখতে সাবান, পানি অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
  • এমপক্সে আক্রান্ত এমন ব্যক্তিকে বাড়িতে আইসোলেট (পরিবারের অন্য সদস্য থেকে দূরে রাখতে আলাদা একটি ঘরে) রাখুন।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা জিনিস আলাদা করে দিন। রোগীর খাওয়া খাবার খেতে বিরত থাকুন। শারীরিক সম্পর্ক থেকেও বিরত থাকুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নিজে সুরক্ষিত থাকতে এমপক্স আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হলেও তার থেকে অন্তত ৩ মাস শারীরিক দূরত্ব রাখা জরুরী।
  • এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত এমন ব্যক্তির সঙ্গে দূর থেকে কথা বললেও বাতাসের মাধ্যমে আপনার আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই এমপক্স রোগী থেকে দূরে রাখুন।
  • এমপক্স রোগীর চিকিৎসকদের তাই পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। প্রয়োজনে সেফটি প্রটোকল মেনে চলতে হবে।
  • রোগী আপন রোগ নয়, এ বার্তা আশপাশের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিন। পাশাপাশি এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাড়িতে আইসোলেট রাখার পরামর্শ দিন। দ্রুত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে বলুন।
  • আক্রান্ত ব্যক্তিসহ সবাই এমপক্স প্রতিরোধে যেখানে সেখানে থুথু, কফ ফেলা থেকে বিরত থাকুন। কাশি কিংবা হাঁচি দেয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করুন। টিস্যু ব্যবহার করলে ঢাকনাযুক্ত ময়লার ঝুড়িতে ব্যবহার করা টিস্যু ফেলুন।
  • বাড়িতে পোষা প্রাণি থাকলে তা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
  • বাইরের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। বাড়িতে যেকোনা খাবার তৈরি করলে আগুনের তাপে ভালো করে তা রান্না করুন।
  • ভাইরাস সম্পর্কে শিশুরা অবগত না হওয়ার কারণে এমপক্সে আক্রান্তের ঝুঁকিতে শিশুরাই বেশি রয়েছে। তাই পরিবারে শিশুদের যত্নে বিশেষ গুরুত্ব দিন। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
মাংকিপক্সের চিকিৎসা:

এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় গুটি বসন্তের টিকা ৮৫% কার্যকর। তাই বর্তমানে মাংকি-পক্সের জন্য এই টিকাই ব্যবহার করা হচ্ছে।

মাংকিপক্সের প্রতিরোধে সতর্কতা:

দেশে মাংকি পক্স সচেতনতায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আপনার শরীরে এর কোনো লক্ষ্মণ দেখা দিলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অথবা সংক্রমিত দেশ ভ্রমণের ২১ দিনের মধ্যে এই লক্ষ্মণ দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত হটলাইনে “১৬২৬৩ অথবা ১০৬৫৫” নম্বরে যোগাযোগ যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে সকল বিমান্দর ও স্থল বন্দরে মাংকি পক্স নিয়ে বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে মাংকিপক্স কোভিডের মত অতিমারি রূপ ধারন করতে পারে। এর থেকে বাঁচতে নিজে সচেতন থাকি এবং কোভিড কালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।

---- বাউল পানকৌড়ি ( ২১.০৮.২০২৪)

মন্তব্যসমূহ