আমাদের একজন জহির রায়হান ছিলেন
কিংবদন্তি জহির রায়হানের পুরো নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম জাফর। জহির রায়হান নামটি রাজনীতির সূত্রে পাওয়া। ৫৩-৫৪ সালের তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। কমরেড মনি সিংহের দেওয়া রাজনৈতিক নাম ‘রায়হান’ গ্রহণ করে জহির রায়হান নাম রাখেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে ভাবিয়ে তুলতো সব সময় । ছাত্র জীবনে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জেলে যেতে হয়ে তাঁর । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে জেলে যেতে হয়েছিলো আরেকবার।বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবি।
জন্ম তাঁর ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নে। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার। বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ছাত্র জীবন থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন। প্রথম গল্প গ্রন্থ “সূর্য গ্রহণ” প্রকাশিত হয় ১৩৬২ বঙ্গাব্দে। প্রথম উপন্যাস। শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। খুব বেশি লেখালিখে না করলেও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার ছিলেন।
উপন্যাস সমূহের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ:
- শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০)
- হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)
- আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)
- বরফ গলা নদী (১৯৬৯)
- আর কতদিন (১৯৭০)
- কয়েকটি মৃত্যু (প্রথম সংস্করণ ১৯৯০)
- একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০)
- তৃষ্ণা (১৯৬২)
গল্প সমূহ:
সূর্যগ্রহণ প্রথম গল্পগ্রন্থ,সোনার হরিণ, সময়ের প্রয়োজনে,একটি জিজ্ঞাসা,হারানো বলয়, বাঁধ, নয়াপত্তন, মহামৃত্যু, ভাঙাচোরা, অপরাধ, স্বীকৃতি, অতি পরিচিত, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, জন্মান্তর, পোস্টার,ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি, কতকগুলো কুকুরের আর্তনাদ,কয়েকটি সংলাপ (১৯৭১), দেমাক, ম্যাসাকার, একুশের গল্প।
চলচ্চিত্র জীবন এবং পরিচালিত চলচ্চিত্র :
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগত ও জীবনমুখী সাহিত্য ধারায় জহির রায়হানের অবদান প্রধান এবং প্রথম।তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ১৯৫৭ সালে। নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ ১৯৬১ সালে। এ ছাড়াও ‘বাহানা’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ তার নির্মিত কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ আজো ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ।
- কখনো আসেনি (১৯৬১)
- সোনার কাজল (১৯৬২)
- কাচের দেয়াল (১৯৬৩)
- সঙ্গম (১৯৬৪)
- বাহানা (১৯৬৫)
- একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৬৫)
- বেহুলা (১৯৬৬)
- আনোয়ারা (১৯৬৭)
- জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
- Let There Be Light (১৯৭০)
- Stop Genocide (১৯৭১)
- Birth of a Nation A state is born (১৯৭১)
- Children of Bangladesh (১৯৭১)
- Surrender (১৯৭১)
চলচ্চিত্রের পোস্টার:
শেষ কথা:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর, প্রধানত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে যে পরিকল্পিত ও বিস্তৃত গণহত্যা চালায়। একাত্তরের গণহত্যার বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার জন্য জহির রায়হান স্টপ জেনোসাইড-এ বাংলাদেশের গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দেশে ফিরেই ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের জন্য জহির রায়হান একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য প্রধানত দায়ী জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক আলবদর বাহিনী। জহির রায়হানের বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি শুধু তথ্য-বিবরণই সংগ্রহ করেনি, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী আলবদরের কয়েকজন নেতাকে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছিল, যাদের অন্যতম জামায়াতের ঢাকা শহরের তৎকালীন এবং জহির রায়হানের অগ্রজ বরেণ্য লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী খালেক মজুমদার। স্বাধীণ দেশে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সাহিত্য চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি জহির রায়হানের। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
--- বাউল পানকৌড়ি (১৯.০৮.২০২৪)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন